[সম্প্রতি তাজউদ্দীন আহমদ-এর যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী জ্যৈষ্ঠ কন্যা শারমিন আহমদ তার পিতাকে নিয়ে স্মৃতিচারণমূলক একটি গ্রন্থ লিখেছেন, যার নাম ‘তাজউদ্দীন আহমদ: নেতা ও পিতা।’ এই বইয়ে শারমিন আহমেদ তাঁর বাবা তাজউদ্দীন আহমদের পাশাপাশি শেখ মুজিবুর রহমান ও স্বাধীনতা আন্দোলনের তখনকার নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে অনেক অন্তরঙ্গ পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেছেন। তারই কিছু চুম্বক অংশ প্রোবনিউজ-এর পাঠকদের জন্য এখানে তুলে ধরা হলো। এবার প্রকাশিত হচ্ছে গ্রন্থ পর্যালোচনার দ্বিতীয় কিস্তি।]
শারমিন আহমদ-এর ভাষ্য থেকে প্রতীয়মান হয় স্বাধীনতার পরই থেকেই ধীরে ধীরে তাজউদ্দীন আহমদের মাঝে প্রশাসন পরিচালনার পদ্ধতি নিয়ে হতাশা চলতে থাকে।
শেখ মুজিবুর রহমানের অনেক সিদ্ধান্তে তিনি ছিলেন ক্ষুব্ধ।
এ বিষয়ে গ্রন্থে অনেক ঘটনার বিবরণ দেয়া হয়। যেমন, সেনাবাহিনীর দুর্নীতি বিরোধী অভিযানে জনৈক এমপির বাসা থেকে রিলিফের সামগ্রী উদ্ধারের পরও তার সাজা না হওয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। এ নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাকবিতন্ডা শেষে তাজউদ্দীন দুঃখ করে মন্তব্য করেছিলেন ‘মুজিব ভাই, শেষ পর্যন্ত আর্মিকেও ক্ষেপিয়ে দিলেন।’
মুজিবের পাকিস্তান সফরে তাজউদ্দীনের সায় ছিল না উল্লেখ করে শারমিন আহমদ ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভুট্টো-মুজিব শলা-পরামর্শেরই ফসল ছিল পাকিস্তানের যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা প্রদর্শন।
১৯৭৪ সালের মে মাসে মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দিনপন্থী হিসেবে বিবেচিত কয়েকজন মন্ত্রীর বাদ পড়া প্রসঙ্গে তিনি ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের জবানিতে জানান, মন্ত্রিসভা গঠনের সময়ই শেখ মুজিবুর রহমান সকল মন্ত্রির স্বাক্ষরযুক্ত পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। আলোচিত মন্ত্রীদের বাদ দেয়ার ক্ষেত্রে ঐ পদত্যাগপত্রই ব্যবহার করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, সেবার যেসব মন্ত্রী বাদ পড়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন নূরজাহান মুরশিদ, জেনারেল ওসমানী, শেখ আব্দুল আজিজ, আমীরুল ইসলাম প্রমুখ।
শারমিন আহমদের মতে মুজিব-তাজউদ্দীন বিবাদের আরেকটি উপলক্ষ্য ছিল বাকশাল গঠন। তাজউদ্দীন এইরূপ একদলীয় ব্যবস্থার সমর্থক ছিলেন না।
তাজউদ্দীনের পদত্যাগ সম্পর্কেও বিস্তারিত জানিয়েছেন শারমিন। ১৯৭৪ সালের ১৩ অক্টোবর দীর্ঘদিন বিদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে তাজউদ্দীন বিমানবন্দরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘বর্তমান জাতীয় দুর্যোগকালে উটপাখির মতো বালিতে মাথা গুঁজে যদি ভাবা হয় যে ঝড় থেমে গেছে তা হবে মারাত্মক ভুল।’ তাজউদ্দীনের এই মন্তব্য ছিল দেশের তখনকার সামগ্রিক পরিস্থিতিতে তার হতাশার প্রকাশ। কিন্তু এটা ছিল মুজিবের সঙ্গে তার সম্পর্কের কফিনে শেষ পেরেকের মতো। ২৬ অক্টোবর দুপুরে অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করতে হয় যুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রীকে।
শারমিন আহমদ সেইদিনকার বিবরণ দিয়েছেন এভাবে: ‘পদত্যাগের ক’ঘণ্টা আগে থেকেই সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা সচিবালয় ঘিরে রেখেছিল। পদত্যাগ করার পরও যেন আব্বুর মুক্তি মিললো না। কড়া নজর রাখা হলো। আব্বুর গতিবিধির ওপর রিপোর্ট করার জন্য সরকারি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে নিযুক্ত করা হলো। আব্বু দুঃখ করে বলতেন, পাকিস্তান আমলেও যেমন পেছনে গোয়েন্দা লেগে থাকতো, স্বাধীন বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা।’[পৃ. ১৯৩]
এইরূপ তিক্ততা ক্রমে আরও বাড়ছিলো। শারমিন আহমদ জানাচ্ছেন, তাজউদ্দীনের বিদেশ ভ্রমণেও এক ধরনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাখা হয়েছিল। রাষ্ট্রপতির অনুমতি ছাড়া তাকে ভিসা প্রদান না করার জন্য বলে রাখা হয় বিদেশী দূতাবাসগুলোকে। প্রাক্তন মন্ত্রী মফিজ চৌধুরীর চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন যেতে চাইলে স্থানীয় রাষ্ট্রদূত তাকে উপরোক্ত নিষেধাজ্ঞার কথা জানান।
তাজউদ্দীন আহমদ-এর জ্যৈষ্ঠ কন্যা গ্রন্থে [পৃ. ২১২] এও জানিয়েছেন, পঁচাত্তর নাগাদ মুজিব কাকুর জনপ্রিয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে যায়। হতাশাগ্রস্ত জনগণ তখন স্বৈরশাসনের অবসান কামনা করছিল।’ শারমিন এও লিখেছেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের ঘটনাবলীর আগাম সংবাদ জুলাই মাসের শেষদিকে সাবেক অর্থমন্ত্রী পেয়েছিলেন এবং সেটা পারস্পরিক তিক্ততা সত্ত্বেও তিনি মুজিবকেও জানিয়েছিলেন। তবে মুজিব সেটা আমলে নেননি। [পৃ. ২১১]
প্রোব/আপা/পি/২৬.০৪.২০১৪