প্রোবনিউজ, ঢাকা: দেশে তরুণদের বেকারত্ব ঘোচাতে সরকারের বহুল আলোচিত ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি’ প্রত্যাশিত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। তিনটি জেলায় এই প্রকল্পের পাইলট কর্মসূচির মূল্যায়ন শেষে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) তাদের এক মূল্যায়ন বলেছে, এই কর্মসূচিতে সুশাসনের অভাব ছিল এবং দুর্নীতির সুযোগ তৈরির পাশাপাশি সরকারি অর্থ অপচয়ের পথ সুগম করেছে তা।
এ বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রকাশিত ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক টিআইবির ঐ প্রতিবেদনে বলা হয় এই কর্মসূচির অধীনে কুড়িগ্রাম, বরগুনা ও গোপালগঞ্জে ৫৬,০৫৪ জনের মাঝে ৮১৬ কোটি টাকা ব্যয় হলেও বেকারত্ব ঘোচাতে অত্র এলাকায় তা ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারেনি। সুবিধাভোগী তরুন-তরুণী, অভিভাবক ও বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে আলাপচারিতার ভিত্তিতে টিআইবি এই মূল্যায়ন প্রতিবেদন প্রণয়ন করেছে।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, প্রাথমিকভাবে উল্লিখিত পাইলট কর্মসূচি ১৯৮৮ জনের মাঝে হওয়ার কথা থাকলেও ধীরে ধীরে সুবিধাভোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ গুন বেশি। এছাড়া পাইলটিংয়ের ধারণাপত্রে দেশের দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী দুটি জেলা (বরগুনা ও কুড়িগ্রাম) অন্তর্ভুক্ত করার কথা থাকলেও পাইলটিংকালে তাতে গোপালগঞ্জকে জুড়ে দেয়া হয়Ñ অথচ দারিদ্র্য মানচিত্র অনুযায়ী গোপালগঞ্জের চেয়ে অধিক দরিদ্র অনেক জেলা রয়েছে দেশে। উল্লেখ্য, বর্তমান সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলোর মধ্যে ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য এবং সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারে ‘নতুন প্রজন্মের যুব সমাজকে দুই বছরের জন্য ন্যাশনাল সার্ভিসে অন্তর্ভুক্তি’র অঙ্গীকার রয়েছে।
২০১০ সালের নীতিমালা অনুযায়ী এই কর্মসূচিতে ১৮-৩৫ বছর বয়সী মাধ্যমিক উত্তীর্ণ বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের অন্তর্ভুক্তির কথা। নিয়মানুযায়ী পরিবার প্রতি একজন বেকারকে অন্তর্ভুক্ত করার বিধান থাকলেও অনুসন্ধানে এমনও দৃষ্টান্ত পাওয়া গেছে, এক পরিবারের সাত জন সদস্য কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। মূলত বেকার শনাক্ত করার ক্ষেত্রে যথাযথ নীতিমালা ও জরিপের অভাব এবং দলীয় বিবেচনায় প্রার্থী বাছাইয়ের কারণে এরূপ ঘটেছে। এই কর্মসূচির সুবিধাভোগী বাছাইয়ের দায়িত্বে ছিল উপজেলা সমন্বয় কমিটি।
কর্মসূচি অনুযায়ী প্রত্যেক বেকার তরুণ-তরুণী তিন মাসের প্রশিক্ষণ শেষে দু’বছর সরকারের বিভিন্ন কার্যক্রমে সংযুক্ত হয়েছিল এবং তাতে এক লাখ ৫৫ হাজার টাকা করে পেয়েছে। সবচেয়ে বেশি (প্রায় ৩৫ %) বেকারকে সংযুক্ত করা হয়েছিল এমপিওভুক্ত রেজিস্ট্রাড প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সংযুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়খাত ছিল কৃষি সম্প্রসারণ কার্যক্রম।
তবে টিআইবি’র অনুসন্ধানে দেখা যায়, সুবিধাভোগী বাছাইয়ের মতোই কর্মস্থল নির্ধারণে যথাযথ পূর্ব জরিপ ও পরিকল্পিত প্রস্তুতি না থাকায় এই কর্মসূচি থেকে প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন লাভবান হয়নি তেমনি বেকার যুবকরাও আর্থিক প্রাপ্তি ছাড়া ভবিষ্যত পেশাজীবনের জন্য কোনরূপ দরকারি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পারেনি। কর্মসূচিতে যুক্ত হওয়ার শর্তাবলী লঙ্ঘন করেই অনেক শিক্ষার্থীকে এই কর্মসূচিতে কাজ দেয়া হয়। আবার কেউ কেউ ব্যবসার পাশাপাশি এই কর্মসূচিতে সংযুক্ত হয়েছে। মূলত দলীয় বিবেচনায় এসব প্রার্থীকে কর্মসূচিতে যুক্ত করা হয় এবং তাদের অনিয়মকে কোনভাবে রোখা যায়নি।
সাধারণভাবে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিগুলো বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে গৃহীত হলেও ‘ন্যাশনাল সার্ভিস’-এর পাইলটিং থেকে দেখা গেছে, এর সংখ্যাগরিষ্ঠ সুবিধাভোগী হয়ে দাঁড়িয়েছে দরিদ্র নয় এমন জনগোষ্ঠী। যদিও দেশে বর্তমানে ১৫ বছরের অধিক বয়সী কর্মক্ষম প্রায় ছয় কোটি জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬ শতাংশই বেকার এবং এর বাইরেও বিপুল তরুণ-তরুণী রয়েছে ছদ্মবেকার। আবার জনসংখ্যার ১৫ শতাংশের অধিক রয়েছে হতদরিদ্র।
অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচিতে যুক্তরা অনিয়মিতভাবে তাদের ভাতা পেলেও প্রশিক্ষকরা তাৎক্ষণিকভাবেই তাদের ভাতা নিয়ে নিয়েছেন এবং এক্ষেত্রে বিপুল অনিয়ম হয়েছে। একজন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা প্রশিক্ষণ বাবদ ৩ লাখ ৮৮ হাজার টাকা উত্তোলন করেছেন। প্রতি প্রশিক্ষণের জন্য ৫ শত টাকা হিসেবে তাঁর ৭৭৮টি প্রশিক্ষণ নেয়ার কথাÑ যা কার্যত অবিশ্বাস্য!
উল্লেখ্য, গত অক্টোবরে এই পাইলট কর্মসূচি শেষ হওয়ার পর বর্তমানে তার আলোকে রংপুরের ৮টি উপজেলায় নতুন কর্মসূচি বাস্তবায়ন হচ্ছে। ভবিষ্যতে এই কর্মসূচির পরিধি আরও বাড়তে পারে। যুব ও ক্রিড়া মন্ত্রণালয় ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচির বাস্তবায়নকারী মন্ত্রণালয় হিসেবে কাজ করছে। সরকারের নিয়োগকৃত মূল্যায়নকারী পাইলটিংকে ‘সফল’ উল্লেখ করে তা দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার সুপারিশ করেছে।
প্রোব/আপা/জাতীয়/১২.০৪.২০১৪